ভূমিকম্প চলাকালীন করণীয়, জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ গুলো
ভূমিকম্প চলাকালীন করণীয়: ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ ঘটে যায়। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে সঞ্চিত শক্তি মুহূর্তের মাঝেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর সেই কম্পন মানুষ, ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোর উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ভূমিকম্পের সময় কীভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখা যায়, কীভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং কোন আচরণই বা জীবনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এসব জানা অত্যন্ত জরুরি। অনেক মানুষই আতঙ্কের মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় বিপদে পড়ে, অথচ সঠিক জ্ঞান ও সামান্য প্রস্তুতি অনেক জীবন বাঁচাতে পারে। এই ব্লগে ভূমিকম্প চলাকালীন করণীয় সম্পর্কে জরুরি পদক্ষেপ গুলো এবং বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
ভূমিকম্প শুরু হলে প্রথম যে কাজ গুলো মাথায় রাখা জরুরি
ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার সাথে সাথেই সবার প্রথম কাজ হলো শান্ত থাকা এবং নিজের অবস্থান অনুযায়ী নিরাপদ সিদ্ধান্ত নেওয়া। আতঙ্কিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়ে। আপনি যদি ঘরের ভিতরে থাকেন, তখন বাইরে বের হওয়াই সবসময় নিরাপদ নাও হতে পারে, কারণ কম্পনের সময় চারপাশের দেয়াল, বারান্দা বা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এ অবস্থায় ঘরের ভেতরেই মজবুত ও ভারী আসবাবপত্রের পাশে থাকা সবচেয়ে ভালো, কারণ এগুলো ভেঙে পড়া জিনিসপত্র থেকে আশ্রয় তৈরি করে। আবার যদি আপনি বিছানায় থাকেন, তবে মাথা রক্ষার জন্য বালিশ বা হাত দিয়ে মাথা ঢেকে একই জায়গায় স্থির থাকা নিরাপদ পন্থা।
গ্লাস, জানালা বা ঝুলন্ত জিনিস থেকে দূরে থাকার গুরুত্ব
ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে বেশি বিপদ আসে ভেঙে পড়া কাঁচ বা ঝুলন্ত জিনিস থেকে। জানালার কাঁচ, শোকেসের গ্লাস, লাইট, ফ্যান বা ঝাড়বাতি ভূমিকম্পের ধাক্কায় সহজেই নিচে পড়ে যেতে পারে। তাই কম্পন শুরু হওয়ার সাথে সাথে এমন যেকোনো উপাদান থেকে দূরে সরে যাওয়া খুবই জরুরি। যদি আপনি রান্নাঘরে থাকেন, তাহলে চুলা বা গরম জিনিস থেকে দূরে থাকা আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো আগুন লাগানোর ঝুঁকি বাড়ায়। নিরাপদ কোন কোণে গিয়ে মাথা রক্ষা করে বসে বা শুয়ে থাকা জীবন রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বাড়ির বাইরে থাকলে সতর্কতার মাত্রা আরও বাড়াতে হবে
যদি ভূমিকম্পের সময় আপনি বাইরে থাকেন, তবে আপনার চারপাশে কী আছে সেটি দ্রুত লক্ষ্য করুন। উঁচু ভবন, বিলবোর্ড, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা গাছ এগুলোর যেকোনোটি কম্পনের কারণে পড়ে যেতে পারে। তাই এমন কোনো খোলা জায়গায় চলে যাওয়া ভালো যেখানে উপর থেকে কিছু পড়ে এসে আঘাত করতে পারবে না। যদি আপনি রাস্তার পাশে থাকেন, তাহলে গাড়ি থেমে থাকলে তার কাছ থেকে দূরে সরে থাকা ভালো, কারণ গাড়ি ঝাঁকুনিতে গড়িয়ে যেতে পারে বা আশপাশের গাছ ও খুঁটি পড়ে গাড়ির ওপর ভেঙে পড়তে পারে। একইভাবে ব্যস্ত সড়কে থাকলে দ্রুত গাড়ির চলাচল থেকে দূরে থাকতে হবে যাতে আতঙ্কের সময় দুর্ঘটনা তৈরি না হয়।
যানবাহনে থাকলে কী করবেন
ভূমিকম্পের মুহূর্তে যদি আপনি গাড়ি বা মোটরবাইকে থাকেন, তবে প্রথম কাজ হবে নিরাপদভাবে ব্রেক করে রাস্তার এক পাশে থামা। অনেক চালক দ্রুত গাড়ি থামাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারায়, যা অতিরিক্ত দুর্ঘটনা ডেকে আনে। গাড়ি থামানোর পর গাড়ির ভেতরেই থাকা বেশি নিরাপদ, কারণ বাইরের পরিবেশে বিদ্যুতের তার বা উপর থেকে পড়ে আসা ধ্বংসাবশেষ আঘাত করতে পারে। তবে সেতু, ওভারপাস বা সুড়ঙ্গের নিচে গাড়ি থামানো বিপজ্জনক হতে পারে, তাই জায়গা নির্বাচন করবেন খুব সতর্কতার সাথে।
অচলাবস্থায় মনের জোর ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি
ভূমিকম্পের সময় ভয়, চাপ ও আতঙ্ক স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ভয়ই অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আসে। তাই যেই পরিবেশেই থাকুন না কেন, গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে আতঙ্ক বাড়তে পারে, তবে এমন পরিস্থিতিতে ও স্থির থাকা প্রয়োজন। মোবাইলের টর্চ ব্যবহার করে আশপাশ বুঝে নিন, তবে ফোনের চার্জ সংরক্ষণ করাও জরুরি, কারণ পরবর্তীতে আপনি জরুরি যোগাযোগ করতে হতে পারে। মনে রাখুন, ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট স্থায়ী হয়, তাই অল্প সময় স্থির থেকে সচেতন থাকা সর্বোত্তম আচরণ।
কম্পন থামার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ও আশেপাশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
ভূমিকম্প থেমে গেলে অনেকেই মনে করেন বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু আসলে ঠিক তখনই দ্বিতীয় দফা বিপদ দেখা দিতে পারে। ভবনের ভিতরে ফাটল সৃষ্টি হতে পারে এবং সেগুলো যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। তাই ধীরে ধীরে বের হওয়ার আগে চারপাশ দেখে নেওয়া ভালো। নিরাপদ পথ বেছে নিয়ে বের হওয়া উচিত এবং লিফট ব্যবহার না করাই শ্রেয়। লিফটের তার ছিঁড়ে যাওয়া বা আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাইরে যাওয়ার পর আশেপাশে গ্যাসের গন্ধ, আগুন বা ভেঙে পড়া বৈদ্যুতিক তার আছে কিনা নিশ্চিত করুন। প্রয়োজন হলে দ্রুত স্থানীয় উদ্ধারকর্মী বা জরুরি সেবাকে খবর দিন।
পরিবার ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পদ্ধতি
যে ঘরে ছোট বাচ্চা, বয়স্ক মানুষ বা শারীরিকভাবে অসুস্থ কেউ থাকে, সেখানে ভূমিকম্পের সময় তাদের সুরক্ষা একটু আলাদাভাবে দেখতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে মাথা রক্ষা করা এবং নিরাপদ কোণে নিয়ে যাওয়া ভালো। বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষকে সহায়তা ছাড়া সরানো কঠিন হতে পারে, তাই তাদের কাছে থেকে ধীরস্থিরভাবে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যান। পরিবারের সবাইকে আগে থেকেই একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ জায়গার ধারণা দিয়ে রাখলে জরুরি অবস্থায় বিভ্রান্তি কমবে এবং সবাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
ভূমিকম্পে বেঁচে থাকার মূল চাবিকাঠি সচেতনতা ও প্রস্তুতি
ভূমিকম্প কোনো সময়ই থামানো যায় না, কিন্তু সচেতনতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। জীবন বাঁচানো যায় এক সেকেন্ডের সঠিক পদক্ষেপে। তাই ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বাস্তবতা বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপদ স্থানে যাওয়া, মাথা ও শরীর রক্ষা করা এবং কম্পন থামার পর সতর্কভাবে জায়গা ত্যাগ করা এসব বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে। পরিবার, প্রতিবেশী এবং সমাজের মানুষের সাথে মিলে নিয়মিত সচেতনতা তৈরি করা গেলে বিপদের সময়ে ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। নিরাপদ থাকুন, সচেতন থাকুন, আর নিজের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের মানুষের নিরাপত্তার কথাও ভাবুন।
.png)
.png)
.png)