সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য ১০ টি
আজকের এই ব্লগে সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য তুলে ধরবো।আশাকরি উপকারে আসবে । বাংলা ভাষার ইতিহাসে সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। সাধু ভাষা প্রাচীন ও শাস্ত্রীয় ভঙ্গির, যেখানে বাক্য দীর্ঘ ও আনুষ্ঠানিক।
অন্যদিকে চলিত ভাষা আধুনিক, সহজ ও দৈনন্দিন ব্যবহারের সঙ্গে মানানসই। নিচে আমরা ১০টি প্রধান পার্থক্য দেখব, প্রতিটি অংশে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও উদাহরণসহ।
সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য
১) সর্বনাম ও নির্দেশক শব্দ
সাধু ভাষায় সর্বনামগুলো তুলনামূলকভাবে জটিল এবং শাস্ত্রীয় রূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন ইহা, উহা, তাহা ইত্যাদি। চলিত ভাষায় এর পরিবর্তে সহজ রূপ ব্যবহার হয়, যেমন এটা, ওটা, সেটা। ফলে চলিত রূপে পাঠক বা শ্রোতার কাছে বক্তব্য দ্রুত এবং স্পষ্টভাবে পৌঁছে যায়।
উদাহরণ:
- সাধু: তাহা সত্য নহে।
- চলিত: ওটা সত্য না।
২) ক্রিয়ার কাল ও রূপান্তর
সাধু ভাষায় ক্রিয়ার রূপ বেশ দীর্ঘ এবং আভিজাত্যপূর্ণ। যেমন করিতেছি, করিলাম, করিব। চলিত ভাষায় এই রূপ গুলো সংক্ষেপিত হয়ে সহজ ভাবে ব্যবহৃত হয় করছি, করলাম, করব। চলিত রূপ স্বাভাবিক কথোপকথনে বেশি মানানসই এবং সহজ পাঠ্য।
তুলনা:
- করিতেছি ↔ করছি
- করিলাম ↔ করলাম
- করিব ↔ করব
৩) হওয়া ক্রিয়ার ব্যবহার
বাংলা ভাষায় ‘হওয়া’ ক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধু রূপে এটি প্রকাশিত হয় হইল, হইয়া, হইতেছে ইত্যাদি। চলিত ভাষায় এর সহজ রূপ হলো, হয়ে, হচ্ছে। এই পার্থক্য বাংলা সাহিত্যের রূপান্তরে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।
উদাহরণ:
সাধু: সমাপন হইল।
চলিত: শেষ হলো।
৪) Participle বা যোজক ক্রিয়া
যোজক ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও পার্থক্য প্রকট। সাধু ভাষায় “ ইয়া ” প্রত্যয় বেশি ব্যবহৃত হয়, যেমন করিয়া, গিয়া, থাকিয়া। চলিত রূপে তা সহজভাবে “-ে” বা “য়ে” করে, গিয়ে, থেকে ইত্যাদি। এর ফলে বাক্যের প্রবাহ চলিত রূপে আরও প্রাঞ্জল হয়।
উদাহরণ:
- সাধু: ভোজন করিয়া তিনি গৃহে গমন করিলেন।
- চলিত: খেয়ে তিনি বাড়ি গেলেন।
৫) শব্দ ভাণ্ডারের ধরণ
সাধু ভাষায় শব্দভাণ্ডার মূলত তৎসম, সংস্কৃত ঘেঁষা এবং প্রায়ই ভারী শোনায়। যেমন গৃহ, ভোজন, গমন। চলিত ভাষায় দেশজ বা তদ্ভব শব্দের আধিক্য বাড়ি, খাওয়া, যাওয়া। এজন্য চলিত রূপ পাঠকের কাছে বেশি স্বাভাবিক মনে হয়।
তুলনা:
- সাধু: গৃহ, ভোজন, গমন
- চলিত: বাড়ি, খাওয়া, যাওয়া
৬) নেতিবাচক রূপ (না/নয়/নাহি)
সাধু ভাষায় নেতিবাচক রূপে নহে, নাহি, নাই ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়, যা আনুষ্ঠানিক ভঙ্গি প্রকাশ করে। চলিত ভাষায় না, নয়, করেনি, করিনি ইত্যাদি সহজ শব্দ ব্যবহৃত হয়। ফলে চলিত রূপের ব্যবহার বেশি প্রিয় ও গ্রহণ যোগ্য।
উদাহরণ:
- সাধু: ইহা গ্রহণযোগ্য নহে।
- চলিত: এটা গ্রহণযোগ্য না।
৭) সংখ্যাবাচক ও পর্যায়সূচক রীতি
সাধু ভাষায় তালিকা বা ধাপ নির্দেশ করতে প্রথমতঃ, দ্বিতীয়তঃ, অতঃপর এরকম রূপ ব্যবহৃত হয়। চলিত রূপে এগুলো সহজ করে বলা হয় প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তারপর। এই পরিবর্তন ভাষাকে আরও সরল করে তোলে।
তুলনা:
- সাধু: প্রথমতঃ, অতঃপর
- চলিত: প্রথমত, তারপর
৮) বাক্যগঠন ও দৈর্ঘ্য
সাধু ভাষায় সাধারণত দীর্ঘ বাক্য, জটিল সমাস ও আনুষ্ঠানিক ভঙ্গি দেখা যায়। চলিত ভাষায় ছোট বাক্য, সরল গঠন ও কথোপকথনমুখী ছন্দ বেশি ব্যবহৃত হয়। এ কারণে চলিত গদ্য সহজবোধ্য এবং জনপ্রিয়।
উদাহরণ:
- সাধু: পরম্পরাগত নিয়মাবলী অনুসরণ করিয়া কার্যে প্রবৃত্ত হইবে।
- চলিত: পুরোনো নিয়ম মেনে কাজ শুরু করবে।
৯) সম্বোধন ও ভদ্রতাসূচক ভঙ্গি
সাধু রূপে “হে” সম্বোধন ও অত্যধিক ভদ্রতাসূচক ক্রিয়ারূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন হে পাঠক, অবগত করিলাম। চলিত ভাষায় সম্বোধন আরও সহজ, যেমন ও“প্রিয় পাঠক, জানালাম।” ফলে চলিত রূপ পাঠকের কাছে বেশি আন্তরিক মনে হয়।
১০) ব্যবহারক্ষেত্র
সাধু ভাষা মূলত প্রাচীন সাহিত্যে, ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হতো। চলিত ভাষা বর্তমানে সংবাদ, পাঠ্যপুস্তক, ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত। আজকের দিনে মানক গদ্য হিসেবে চলিতই গ্রহণযোগ্য।
.png)