সংহতি কি, জাতীয় সংহতি বলতে কি বুঝ ?

সংহতি কি, জাতীয় সংহতি কি ? আজকে আমরা সংহতি কি, জাতীয় সংহতি কি? এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো এই আর্টিকেলে।,

সংহতি কি, জাতীয় সংহতি বলতে কি বুঝ ?

সংহতি কি, জাতীয় সংহতি কি ? আজকে আমরা সংহতি কি, জাতীয় সংহতি কি? এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো এই আর্টিকেলে।আমরা প্রতিনিয়ত সংহতি শব্দটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে শুনি। কখনো এটি পরিবার, সমাজ বা জাতির মধ্যে ব্যবহৃত হয়।

তবে প্রকৃত অর্থে সংহতি এবং জাতীয় সংহতি কী এই দুটি শব্দের গভীরে গেলে আমরা একটি দেশের অগ্রগতির মূল শক্তিকে বুঝতে পারি। চলুন ধাপে ধাপে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করি।

সংহতি কি

সংহতি কি?

সংহতি শব্দটি এসেছে সং এবং হতি এই দুইটি শব্দের মিলন থেকে। এর মানে হলো একত্র হওয়া বা মিলন। সাধারণ অর্থে সংহতি বলতে বোঝানো হয় ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা, ভালোবাসা এবং ঐক্যের বন্ধন কে।

সংহতি এমন একটি অবস্থা, যেখানে মানুষের মধ্যে মতভেদ থাকলেও তারা সম্মিলিত স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকে। এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, সম্প্রদায় কিংবা জাতির মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তা এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি করে। আপনি যেমন একটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা লক্ষ্য করেন, তেমনি একটি সমাজ বা জাতির মধ্যেও সেই আবেগ ও বন্ধন তৈরি হলে তাকে সংহতি বলা হয়।

সংহতির বৈশিষ্ট্য

সংহতির কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এটিকে অন্যান্য সামাজিক গুণ থেকে আলাদা করে তোলে:

  • পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ: সদস্যরা একে অপরের মতামত ও অনুভূতিকে সম্মান করে।
  • সহানুভূতি ও সহানুভব: কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, আনন্দে ভাগীদার হওয়া।
  • সমষ্টিগত স্বার্থে একতা: ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ বা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করা।
  • সংঘর্ষ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: বিরোধ বা মতবিরোধ হলেও তা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা।

সংহতির প্রয়োজনীয়তা

সংহতি ছাড়া কোনো সমাজই টিকে থাকতে পারে না। এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। একটি পরিবারে যেমন একে অপরের প্রতি সমর্থন থাকলে সব সংকট সহজে মোকাবেলা করা যায়, তেমনি একটি জাতিও ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। সংহতি মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলে, সমাজে নৈতিকতা বজায় রাখে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।

জাতীয় সংহতি কি?

জাতীয় সংহতি কাকে বলে

জাতীয় সংহতি অর্থাৎ National Unity হলো একটি জাতির সকল শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঐক্য এবং সহযোগিতার বন্ধন। এটি এমন একটি চেতনা যা জাতিকে একটি সত্তায় রূপান্তরিত করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে।জাতীয় সংহতির মাধ্যমে একজন নাগরিক জাতিকে প্রাধান্য দেয়, জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয় এবং সংকট মুহূর্তে জাতির জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে।

জাতীয় সংহতির গুরুত্ব

জাতীয় সংহতির গুরুত্ব অপরিসীম। একটি জাতির অগ্রগতি ও বিকাশের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে সংহতি। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

  • অখণ্ডতা রক্ষা: জাতীয় সংহতি থাকলে বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ হুমকির সময় জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করতে পারে।
  • উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে: ভেদাভেদ কমে যায় এবং সকলে মিলে কাজ করায় উন্নয়নের গতি বাড়ে।
  • সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে: হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা বা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব হ্রাস পায়।
  • গণতন্ত্র সুসংহত হয়: সংহতির মধ্য দিয়ে জনগণ রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণে এগিয়ে আসে।

জাতীয় সংহতির উপাদানসমূহ

জাতীয় সংহতির জন্য যেসব উপাদান অপরিহার্য তা নিচে তুলে ধরা হলো:

  • ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য: একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ভাষা বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন: বাংলা ভাষা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের মূল।
  • জাতীয় চেতনা: ইতিহাস, ঐতিহ্য, আন্দোলন ও সংগ্রামের স্মৃতি জাতীয় সংহতির ভিত্তি।
  • শিক্ষা ও সচেতনতা: সঠিক জাতীয় ইতিহাস, মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গড়ে তোলা।
  • আর্থ-সামাজিক সাম্য: সমাজে বৈষম্য থাকলে সংহতি বিঘ্নিত হয়। তাই সকলের জন্য সমান সুযোগ জরুরি।
  • নেতৃত্বের দায়িত্বশীলতা: রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতাদের সৎ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা জাতীয় সংহতির চালিকাশক্তি।

জাতীয় সংহতি ও সামাজিক সংহতির পার্থক্য

জাতীয় সংহতি বনাম সামাজিক সংহতি

যদিও জাতীয় সংহতি এবং সামাজিক সংহতি শব্দ দুটি প্রায় কাছাকাছি শোনায়, তবে এদের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটি সুসংহত সমাজ ছাড়া একটি সুসংহত জাতি গঠন সম্ভব নয়।

জাতীয় সংহতি একটি জাতিকে ঘিরে একতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়। এটি বৃহত্তর পরিসরে কাজ করে, যেখানে একটি রাষ্ট্রের সব জনগণ তাদের পরিচয়, ইতিহাস, এবং ভবিষ্যতের লক্ষ্যের ওপর ঐক্যবদ্ধ হয়।

অন্যদিকে, সামাজিক সংহতি বলতে বোঝায় একটি সমাজের ভেতরে ভিন্ন শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা বা গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রদ্ধাবোধ, এবং সহানুভূতির বন্ধন। এটি জাতীয় সংহতির একটি উপাদান হিসেবেও কাজ করে।

মূল পার্থক্যগুলো নিচের টেবিলে উপস্থাপন করা হলো:

বাস্তব উদাহরণসহ ব্যাখ্যা

ধরুন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো বাঙালি জাতি একটি জাতীয় উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল জাতীয় সংহতির সবচেয়ে বড় নিদর্শন। সেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ভাষা, সংস্কৃতি, এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একসাথে লড়েছিল।

অন্যদিকে, যদি আমরা দেখি করোনা মহামারীর সময়, তখন প্রতিবেশী বা সমাজের লোকজন একে অপরকে সাহায্য করেছে চিকিৎসা, খাদ্য, আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। এটি সামাজিক সংহতির বাস্তব রূপ। সমাজের মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এই সংহতির দৃষ্টান্ত।

এই দুই ধরণের সংহতি পরস্পর পরিপূরক। সামাজিক সংহতি ছাড়া জাতীয় সংহতি পূর্ণতা পায় না এবং জাতীয় সংহতি ছাড়া সামাজিক সংহতির বিস্তার সম্ভব নয়।

একটি রাষ্ট্রে জাতীয় সংহতির ভূমিকা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে সংহতির ভূমিকা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি জাতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। যেখানে জাতীয় সংহতি শক্তিশালী, সেখানে রাজনৈতিক হানাহানি বা অস্থিরতার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। কারণ জাতীয় সংহতি মানুষকে একে অপরের প্রতি দায়িত্ববান করে তোলে এবং জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করে।একটি রাষ্ট্রে যখন নাগরিকরা জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তখন তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তারা সংবিধান, রাষ্ট্রীয় আইন ও শৃঙ্খলা মেনে চলে। এর ফলে:

  1. সরকার পরিচালনায় স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
  2. রাজনৈতিক সংকটগুলো সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান হয়।
  3. রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় জনগণের সম্মতি ও সমর্থন পাওয়া সহজ হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশব্যাপী একটি জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিল, যা রাজনৈতিকভাবে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল। এই সংহতি যদি অব্যাহত থাকত, তাহলে অনেক রাজনৈতিক সংকট এড়ানো যেত।

উন্নয়নের জন্য জাতীয় সংহতির গুরুত্ব

জাতীয় সংহতি থাকলে একটি জাতি উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায় এই কথা নিছক কোনো তত্ত্ব নয়, বরং বহু দেশের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত সত্য। উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো ঐক্য, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যা জাতীয় সংহতির মাধ্যমে সম্ভব হয়।

সংহতির ফলে:

  1. সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পায়: কারণ জনগণ একে অপরকে সাহায্য করে।
  2. শ্রমবাজারে সমতা আসে: সব ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ উন্নয়নের সুযোগ পায়।
  3. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়: যাতে বিনিয়োগ এবং ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হয়।
  4. শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়: জাতীয় সংহতির পরিবেশে সরকার ও জনগণ একসঙ্গে কাজ করে।

রুয়ান্ডা বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো সংহতির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও জাতীয় সংহতি যদি দৃঢ় হয়, তাহলে দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও বৈষম্য দূর করে একটি উন্নত রাষ্ট্র গঠন সম্ভব।

জাতীয় সংহতি দিবস

বাংলাদেশে জাতীয় সংহতি দিবস পালিত হয় ৭ নভেম্বর এই দিনটির পেছনে আছে এক ঐতিহাসিক গল্প। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর একাংশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অসাধারণ ঐক্য গড়ে উঠেছিল, যার মধ্য দিয়ে দেশে একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছিল। কিছু মানুষ এটাকে সৈনিক-জনতার বিপ্লব বলে থাকেন, আবার কারও কারও কাছে এটি বিতর্কিতও বটে।

যাই হোক, দিনটিতে সরকারিভাবে নানা অনুষ্ঠান হয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আর বিশেষ টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে স্মরণ করা হয়। তবে, দিনটির গুরুত্ব নিয়ে মানুষের মতামত ভিন্ন হলেও, মূল বার্তাটা একই জাতীয় ঐক্য আর সংহতিই পারে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

শেষকথা,

সংহতি আর জাতীয় সংহতি এই দুটি শব্দের গুরুত্ব আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্র জীবনে পর্যন্ত প্রসারিত। সংহতি শুধু একটি তাত্ত্বিক ধারণা নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া, একটি চর্চা যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কাজে লাগাতে হয়।

একটি পরিবার যেমন ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে টিকে থাকে, তেমনি একটি জাতি সংহতির মাধ্যমে জীবন্ত, উন্নত ও টেকসই হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে আমরা বারবার জাতীয় সংহতির জোরে বড় বড় সাফল্য অর্জন করেছি। তবে বর্তমান বাস্তবতা আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন তোলে আমরা কি সেই সংহতিকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছি? ভবিষ্যতের প্রজন্ম কি আমাদের কাছ থেকে জাতীয় ঐক্যের বাস্তব উদাহরণ পাবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরই দিতে হবে। আর সেই উত্তর শুরু হতে পারে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে  পরিবার, সমাজ, স্কুল, কর্মক্ষেত্র  যেখানেই থাকি না কেন, সংহতির চর্চা যেন অব্যাহত থাকে। তাহলেই একদিন আমরা সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব।

Disclaimer
We strive to provide accurate information, but we cannot guarantee that all details are always fully updated.

Affiliate Disclosure
This post may contain affiliate links. We may receive a commission if you make a purchase through these links, at no extra cost to you. For more details, please visit our Disclaimer Page.

আইটি বিতান
Nilasha Barua

হাই! আমি নিলাশা, প্রযুক্তি, গ্যাজেট রিভিউ এবং নানা ধরনের বিষয় নিয়ে ব্লগ লিখি। পাঠকের জন্য সহজ, প্রাসঙ্গিক এবং তথ্যবহুল কনটেন্ট তৈরি করাই আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য।নতুন তথ্য শেয়ার করতে এবং পাঠকদের সাথে জ্ঞান ভাগাভাগি করতে পছন্দ করি।

Post a Comment