আধুনিক কম্পিউটারের জনক কে ?
প্রিয় পাঠক, কেমনে আছেন সবাই? আজকের ব্লগে আমরা আধুনিক কম্পিউটারের জনক কে? এবং কম্পিউটার নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো , কোথাও যাবেন না শেষ পযর্ন্ত সাথেই থাকুৃন। যখনই আমরা কম্পিউটারের কথা বলি, তখন আমাদের মনের মধ্যে জাগে অসংখ্য প্রশ্ন। এই যন্ত্রটি কে আবিষ্কার করল?
কম্পিউটার এখন আমাদের জীবনের এমন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে ছাড়া আধুনিক সভ্যতা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু আমরা কি কখনও চিন্তা করেছি, এই জটিল কিন্তু দরকারী যন্ত্রটির পেছনে কারা ছিল? কার মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা থেকে আজকের এই কম্পিউটার জগৎ শুরু? এক কথায় বললে, উত্তরটা কিছুটা জটিল।
কারণ, কম্পিউটারের ইতিহাস কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা রচিত নয় এটা একাধিক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, গাণিতিক, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবকের সম্মিলিত অবদানে গঠিত। তবে ইতিহাসে তিনটি নাম বারবার উঠে আসে চার্লস ব্যাবেজ, হাওয়ার্ড অ্যাইকন এবং জন ভন নিউম্যান। চলুন, তাদের প্রত্যেকের অবদান বিস্তারিত ভাবে জেনে নিই।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
হাওয়ার্ড অ্যাইকন: হাওয়ার্ড অ্যাইকন ছিলেন একজন আমেরিকান প্রকৌশলী এবং গণিতবিদ যিনি Mark I নামে পরিচিত প্রাথমিক ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কম্পিউটার তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে IBM এর সহায়তায় তৈরি হওয়া এই যন্ত্রটি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং ৫০ ফুট লম্বা। তবে এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি প্রোগ্রাম যোগ্য। অর্থাৎ ব্যবহার কারীরা নির্দিষ্ট ইন্সট্রাকশন সেট দিয়ে এটি পরিচালনা করতে পারতেন।
এই যন্ত্রের মাধ্যমে অ্যাইকন প্রমাণ করেছিলেন যে গণনার জটিল কাজও স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব। যেটা ছিল আধুনিক কম্পিউটারের একটা বড় ভিত্তি। তিনি প্রথম বারের মতো কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা প্রযুক্তি গতভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। যদিও এটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল কম্পিউটার ছিল না, কিন্তু এটি ছিল এক বিরাট পদক্ষেপ কম্পিউটারের বিকাশে।
চার্লস ব্যাবেজ: চার্লস ব্যাবেজ ছিলেন একজন ইংরেজ গণিতবিদ, দার্শনিক ও উদ্ভাবক। তাঁকেই বলা হয় Father of the Computer। কেন? কারণ তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোগ্রামযোগ্য কম্পিউটারের ধারণা প্রদান করেন যেটিকে বলা হয় অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন।
চার্লস ব্যাবেজের চিন্তা সেই ১৮৩৭ সালের, যখন আজকের মতো কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের অস্তিত্বই ছিল না। তবুও তিনি একটি এমন যন্ত্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন যা নিজে নিজে প্রোগ্রাম ফলো করে গণনা করতে পারবে। ব্যাবেজের ডিফারেন্স ইঞ্জিন এবং পরবর্তীতে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন প্রকল্প ভবিষ্যতের কম্পিউটার প্রযুক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
চার্লস ব্যাবেজ: আধুনিক কম্পিউটারের জনক
চার্লস ব্যাবেজের প্রাথমিক জীবন ও প্রেরণা
চার্লস ব্যাবেজ জন্মগ্রহণ করেন ২৬ ডিসেম্বর, ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডে। তিনি এক ধনী ব্যাংকারের ছেলে হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তাঁর পড়াশোনার সুযোগ ছিল প্রচুর। তিনি Trinity College, Cambridge থেকে গণিতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই সময়ের ব্রিটিশ রাজ্যে পরিসংখ্যানগত হিসাব-নিকাশ এবং টেবিল তৈরি করা হতো হাতে যেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। এই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থাই ব্যাবেজকে অনুপ্রাণিত করেছিল এমন এক যন্ত্র তৈরিতে, যা সঠিকভাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে।
ডিফারেন্স ইঞ্জিন ও অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন
প্রথমে ব্যাবেজ ডিজাইন করেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাণিতিক টেবিল তৈরি করতে পারত। এটি আংশিকভাবে তৈরি হলেও সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি। এরপর তিনি ১৮৩৭ সালে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন নামের একটি নতুন প্রকল্প হাতে নেন।
এই ইঞ্জিন ছিল সত্যিকার অর্থেই কম্পিউটারের প্রথম ধারণা যেখানে মেমোরি, কন্ট্রোল ইউনিট, ইনপুট ও আউটপুট সিস্টেমের পরিকল্পনা ছিল। এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ যান্ত্রিক কম্পিউটার যার মাধ্যমে সাধারণ গাণিতিক হিসাব ছাড়াও শর্তভিত্তিক কমান্ড ও লুপ চালানো সম্ভব হতো।
অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী
অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের ডিজাইনে ব্যাবেজ পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করেন ইনপুট দেওয়ার জন্য। এটি ছিল এমন এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কম্পিউটার নিজে নিজেই নির্দেশনা অনুসরণ করে কাজ করত। মজার বিষয় হলো, এই পাঞ্চ কার্ড সিস্টেমটি পরবর্তীতে IBM-এর মেইনফ্রেম কম্পিউটারে ও ব্যবহৃত হয়েছিল।
ব্যাবেজের যুগান্তকারী ভাবনা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
চার্লস ব্যাবেজের জীবনকালেই তাঁর যন্ত্রগুলো বাস্তবে সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। তবে তাঁর ধারণা এবং নকশা পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য এক অভূতপূর্ব দিশারী হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর তাত্ত্বিক অবদান ছাড়া আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত্তিই তৈরি হতো না। আজও কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রদের প্রথম পাঠেই চার্লস ব্যাবেজের কথা পড়ানো হয়।
অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের ধারণা ও অবদান
কীভাবে কাজ করত অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন?
অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন ছিল একটি প্রস্তাবিত যান্ত্রিক কম্পিউটার যা তৎকালীন সময়ে অভাবনীয় এক ধারণা। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাণিতিক হিসাব করতে পারে এবং প্রোগ্রাম অনুসারে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন পরিচালনা করতে পারে। চার্লস ব্যাবেজ এই ইঞ্জিনে পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করার চিন্তা করেন, যা একটি পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম লোড করার উপায় হিসেবে কাজ করত।
এটি মডিউলার ডিজাইন ছিল, যার মূল চারটি অংশ ছিল:
- মিল (Mill): আজকের দিনের CPU বা প্রসেসরের মতো, এটি ছিল সমস্ত গাণিতিক কাজের কেন্দ্র।
- স্টোর (Store): এটি ছিল মেমোরি ইউনিট, যেখানে ডেটা ও ইন্সট্রাকশন রাখা হতো।
- পাঞ্চ কার্ড ইনপুট: বাইরের নির্দেশনা পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে দেয়া হতো।
- আউটপুট ডিভাইস: প্রিন্টিং ও পাঞ্চ কার্ডে ফলাফল সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
এই যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি শর্তসাপেক্ষ লজিক অনুসরণ করতে পারত এবং লুপ, কন্ডিশনাল ব্রাঞ্চিং ও সাবরুটিন কলের মতো জটিল গাণিতিক যুক্তি বাস্তবায়ন করত। যা আধুনিক প্রোগ্রামিংয়ের মূল ভিত্তি।
অ্যাডা লাভলেসের ভূমিকা ও অবদান
চার্লস ব্যাবেজের পাশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম জড়িয়ে আছে অ্যাডা লাভলেস। তিনি ছিলেন লর্ড বাইরনের কন্যা এবং গণিতজ্ঞ। তিনি ব্যাবেজের অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের জন্য প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখেন, যা তাঁকে ইতিহাসের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
অ্যাডা লাভলেস ব্যাবেজের ডিজাইন সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কেও ভাবেন, যা ব্যাবেজ নিজেও চিন্তা করেননি। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন শুধুমাত্র সংখ্যার উপর কাজ করে না, বরং যেকোনো প্রতীক বা লজিকের উপরেও কাজ করতে পারে। এই চিন্তাধারা থেকেই বের হয়ে আসে আধুনিক সফটওয়্যারের ভিত্তি।
তিনি লিখেছিলেন, কম্পিউটার কেবল মানুষের নির্ধারিত কাজ করে না, এটি এমন কিছু হিসাবও করতে পারে যা মানুষ কল্পনাও করেনি। এই মতবাদ পরবর্তীতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও অটোমেশনের ধারণাকে আরও গভীর করে তোলে।
জন ভন নিউম্যান: ডিজিটাল কম্পিউটারের স্থপতি
নিউম্যান আর্কিটেকচারের মূল উপাদান
যেখানে চার্লস ব্যাবেজ যান্ত্রিক ভিত্তিতে কম্পিউটারের কথা চিন্তা করেছিলেন, জন ভন নিউম্যান সেটিকে ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পথ দেখিয়েছেন। ১৯৪৫ সালে জন ভন নিউম্যান একটি গবেষণাপত্র লেখেন First Draft of a Report on the EDVAC যেখানে তিনি একটি ডিজিটাল কম্পিউটারের কাঠামো বা স্থাপত্য উপস্থাপন করেন। এই কাঠামোই আজকের দিনের কম্পিউটারের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে পরিচিত Von Neumann Architecture।
এই আর্কিটেকচারের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- Stored Program Concept: প্রোগ্রাম ও ডেটা একই মেমোরিতে রাখা হবে।
- বাইনারি সিস্টেমে অপারেশন: যেটি ইলেকট্রনিক ভিত্তিক হিসাবকে দ্রুত ও নির্ভুল করেছে।
- Sequential Execution: একের পর এক ইনস্ট্রাকশন অনুসরণ করা।
- মেমোরি, প্রসেসর, ইনপুট ও আউটপুট ইউনিট: চারটি প্রধান ইউনিটের সমন্বয়।
এই ডিজাইন একদিকে যেমন ডেটা প্রসেসিংকে সহজ করেছে, তেমনি প্রোগ্রামিংয়েরও একটি স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি তৈরি করেছে।
আধুনিক কম্পিউটার ডিজাইনের ভিত তৈরি
নিউম্যানের এই চিন্তাভাবনা ছিল যুগান্তকারী। ENIAC, UNIVAC এবং অন্যান্য প্রাথমিক ডিজিটাল কম্পিউটারগুলো এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। আজকের দিনেও অধিকাংশ কম্পিউটার সিস্টেম এই Von Neumann Architecture অনুসরণ করে চলে। এটি শুধু হার্ডওয়্যার ডিজাইন নয়, সফটওয়্যার উন্নয়নেও বিশাল প্রভাব ফেলেছে।
যদিও পরবর্তীতে হার্ভার্ড আর্কিটেকচারের মতো বিকল্প মডেল এসেছে, তবে নিউম্যান আর্কিটেকচারই আজও সবচেয়ে ব্যবহৃত কাঠামো হিসেবে পরিচিত।
নিউম্যান আর্কিটেকচারের ভূমিকা
মেমোরি, ইনপুট/আউটপুট, সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট
Von Neumann Architecture এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর পরিষ্কার ও কার্যকর ইউনিট ভাগ। এই কাঠামোয় প্রতিটি ইউনিট নির্দিষ্ট কাজ করে এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
- মেমোরি (Memory): ইনস্ট্রাকশন ও ডেটা একসাথে সংরক্ষণ করে।
- সিপিইউ (CPU): এটি নিয়ন্ত্রণ করে কোন ইনস্ট্রাকশন কখন চলবে, কিভাবে চলবে।
- ইনপুট/আউটপুট ইউনিট: কম্পিউটারের বাইরের জগৎ থেকে তথ্য নেয় এবং ফলাফল সরবরাহ করে।
এই সিস্টেমের মাধ্যমে একই হার্ডওয়্যারে ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রাম চালানো সম্ভব, যা কম্পিউটারের বহুমুখিতা বাড়িয়েছে।
কেন নিউম্যান আর্কিটেকচার এখনো প্রাসঙ্গিক?
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিপ লার্নিং এবং বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তির বিকাশ হলেও নিউম্যান আর্কিটেকচারের মূল কাঠামো আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। কারণ এর ডিজাইন এতটাই মৌলিক ও কার্যকর ছিল যে তা সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। শুধু হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটিং বা সুপারকম্পিউটারেই কিছু পরিবর্তিত ডিজাইন ব্যবহৃত হয়।
তবে মোবাইল ফোন থেকে সুপার কম্পিউটার সবখানেই নিউম্যান আর্কিটেকচারের ছাপ স্পষ্ট। এটা নিঃসন্দেহে জন ভন নিউম্যানকে আধুনিক ডিজিটাল কম্পিউটারের স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
কম্পিউটারের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
অ্যাবাকাস থেকে যাত্রা শুরু
কম্পিউটারের ইতিহাস কোনো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রযুক্তির কাহিনী নয়। এটি একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের ফল, যা হাজার বছরের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। সেই প্রাচীন যুগে মানুষ যখন সংখ্যা গোনা শুরু করে, তখনই অ্যাবাকাস নামে এক গাণিতিক যন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। এটি ছিল একটি ম্যানুয়াল ক্যালকুলেটর, যা কাঠের ফ্রেমে বিড লাগানো হয়েছিল এবং হাত দিয়ে বিড সরিয়ে যোগ-বিয়োগের কাজ করা হতো।
অ্যাবাকাসের পরবর্তীতে আসে Napier’s Bones এবং Slide Rule এর মতো আরও কিছু যন্ত্র। এগুলোর মাধ্যমে মানুষের গাণিতিক দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও, সেগুলোর কার্যকারিতা ছিল সীমিত এবং মূলত ক্যালকুলেশনের উপর নির্ভরশীল।
এনিয়াক, ইউনিভ্যাক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন
যান্ত্রিক ক্যালকুলেটরের যুগ থেকে আধুনিক ইলেকট্রনিক যুগে প্রবেশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই সময় গণনার চাহিদা এত বেড়ে গিয়েছিল যে মানুষ স্বয়ংক্রিয়, দ্রুত ও নির্ভুল গণনা ব্যবস্থা খুঁজতে শুরু করে। এর ফলাফল ছিল ENIAC (Electronic Numerical Integrator and Computer) বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক, প্রোগ্রামযোগ্য, সাধারণ উদ্দেশ্য কম্পিউটার।
ENIAC তৈরি করেন জন মোকলি এবং প্রেসপার একার্ট, যা ১৯৪৫ সালে সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়। এটি ছিল ৩০ টন ওজনের এবং প্রায় ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব দিয়ে তৈরি, কিন্তু তখনকার তুলনায় এর গতি ছিল চোখধাঁধানো।এরপর আসে UNIVAC (Universal Automatic Computer), যা ছিল প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ কম্পিউটার। UNIVAC ব্যবহার করে আমেরিকার সেনসাস ব্যুরো তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে।এগুলো ছিল প্রথম দিকের জেনারেশন-১ কম্পিউটার। ধাপে ধাপে কম্পিউটার উন্নত হতে থাকে ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে ট্রানজিস্টর, তারপর ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এবং এরপর মাইক্রোপ্রসেসরের যুগে প্রবেশ করে।
পিসি ও আধুনিক কম্পিউটারের উত্থান
১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৮০ এর শুরুর দিকে IBM প্রথম Personal Computer (PC) বাজারে আনে। এই সময় মাইক্রোসফট ও অ্যাপল কোম্পানিগুলোর যাত্রাও শুরু হয়। বিল গেটস ও স্টিভ জবসের মতো উদ্ভাবকেরা কম্পিউটারকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন।
PC এর উন্নয়ন, GUI (Graphical User Interface), ইন্টারনেট, ওয়েব ব্রাউজার, মোবাইল কম্পিউটিং এবং এখন ক্লাউড কম্পিউটিং পর্যন্ত এই পুরো যাত্রাই এক ঐতিহাসিক রূপান্তর। এটি একদিকে যেমন মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন এনেছে, তেমনি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে তুলেছে।আজকের দিনের সুপারকম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, AI বা রোবট সব কিছুর পেছনে এই দীর্ঘ ইতিহাসের একেকটি স্তম্ভ রয়েছে।
শেষকথা
কম্পিউটারের ইতিহাস একটানা ও রোমাঞ্চকর একটি যাত্রা যেখানে একের পর এক প্রতিভাবান মানুষ তাদের মেধা, শ্রম এবং কল্পনাশক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন। কেউ ছিলেন গণিতবিদ, কেউ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ছিলেন দার্শনিকতাদের চিন্তা, গবেষণা এবং আবিষ্কারগুলো একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছে আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি।
চার্লস ব্যাবেজ যেখানে প্রোগ্রামযোগ্য কম্পিউটারের প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন, সেখানে অ্যাডা লাভলেস সেই যন্ত্রের জন্য প্রথম প্রোগ্রাম লিখে ইতিহাসের প্রথম প্রোগ্রামার হন। হাওয়ার্ড অ্যাইকন সেই ধারণাকে যন্ত্রে রূপ দিয়ে কম্পিউটিংয়ে বিপ্লব আনেন, এবং জন ভন নিউম্যান কম্পিউটারের ডিজিটাল আর্কিটেকচার নির্ধারণ করে ভবিষ্যতের পথ দেখান।
এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে কম্পিউটার আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। আমরা যাদের কম্পিউটারের জনক বলে থাকি, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে এই প্রযুক্তির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন।
ডিসক্লেইমার: এই লেখাটিতে দেওয়া সব তথ্য বিশ্বাসযোগ্য উৎস এবং সাধারণ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তারপরও সময়ের সাথে কিছু তথ্য পরিবর্তন হতে পারে বা ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তাই প্রয়োজনে দয়া করে নিজে থেকে যাচাই করে নিবেন।
FAQs
১. চার্লস ব্যাবেজকে কম্পিউটারের জনক কেন বলা হয়?
চার্লস ব্যাবেজই প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি প্রোগ্রামযোগ্য মেশিনের ধারণা দেন, যা আধুনিক কম্পিউটারের মৌলিক কাঠামোর সাথে মিলে যায়। তাঁর "অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন" ধারণা আজকের CPU, মেমোরি ও ইনপুট-আউটপুট সিস্টেমের ভিত্তি।
২. হাওয়ার্ড অ্যাইকনের মূল অবদান কী?
হাওয়ার্ড অ্যাইকন প্রথম ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার Mark I তৈরি করেন যা প্রোগ্রাম চালাতে পারত। এটি আধুনিক প্রোগ্রামযোগ্য কম্পিউটারের দিকনির্দেশ করে।
৩. জন ভন নিউম্যানের আর্কিটেকচারের বৈশিষ্ট্য কী?
Von Neumann Architecture-এ মেমোরি, CPU, ইনপুট-আউটপুট এবং প্রোগ্রাম একই প্ল্যাটফর্মে সমন্বিত হয়। এটি আজকের কম্পিউটার ডিজাইনের ভিত্তি।
৪. অ্যাডা লাভলেসের অবদান কী ছিল?
অ্যাডা লাভলেস ব্যাবেজের অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের জন্য প্রথম অ্যালগরিদম লেখেন, যাকে আজ বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম বলা হয়।
৫. প্রথম কার্যকর ডিজিটাল কম্পিউটার কোনটি?
ENIAC ছিল বিশ্বের প্রথম কার্যকর ও ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার, যা ১৯৪৫ সালে তৈরি হয় এবং আমেরিকান সেনাবাহিনীর জন্য ব্যবহৃত হয়।